২০১৯ এর শ্রেষ্ঠ ৪ অভিযান

Share

২০১৯ সাল ছিল পর্বতারোহণে আধুনিক আল্পাইনিজম এর জয়জয়কার। বিশ্বব্যাপি পর্বতমালায় রচিত হয়েছে অনেক প্রথম আরোহনের গল্প। আর এইসব গল্পের রচয়িতা যেমন ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ পর্বতারোহী, তেমনি ছিলেন উদীয়মান কিছু তরুণ। আধুনিক আল্পাইনিজমের প্রতিকৃতি হিসেবে এই সব অনেক দুঃসাহসী অভিযানের মাঝ থেকে ৮ সদস্যের বিজ্ঞ বিচারকমন্ডলী বেছে নিয়েছেন শীর্ষ ৪টি অভিযান, যার দুইটি হয়েছে নেপালের হিমালয়ে আর দুইটি পাকিস্তানের কারাকোরামে। পর্বতারোহণের অস্কার খ্যাত “পাইওলেট ডি’অর” এর এই ২০২০ সালের আসর বসছে ১৯শে সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের লেডেক মাউন্টেইন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যাতে তুলে দেয়া হবে এই সম্মাননা পুরষ্কার। উল্লেখ্য যে সম্পূর্ণ বিশুদ্ব আল্পাইন স্টাইলে কোন প্রকার ড্রিলিং ছাড়াই পরিচালিত অভিযান যা থেকে আসে নতুন কোন সামিট বা নতুন কোন রুট – এমন সব অভিযান থেকেই নির্বাচিত হয় বছরে শ্রেষ্ঠ অভিযান।

৪টি পর্বত অভিযানের জন্য ১০ জন বিজয়ীর মাঝে ৬ জন এর আগেই পাইওলেট ডি’অর জিতেছেন। মেরক হোলচেক এবং জেনেক হ্যাক ২০১৮ সালে গাশারব্রাম-১ এর জন্য, মার্ক রিচি ও স্টিভ সোয়েনসন ২০১২ সালে সাশের কাংরি-২ এর জন্য, কেনরো নাকাজিমা ২০১৮ সালে শিশপারে’র জন্য এর আগে একবার করে এই পুরষ্কার জিতলেও কাজুয়া হিরাইডি এর আগে জিতেছেন দুইবার – ২০০৯ সালে কামেট এবং ২০১৮ সালে শিশপারে’র জন্য।

চেমল্যাং (৭৩২১ মিটার)

প্রথম দর্শনেই প্রেমের মতো ২০০১ সালে মারেক হোলচেক প্রথমবার নেপালের মহালাঙ্গুর হিমালের চ্যামলাং  এর উত্তর-পশ্চিম দেয়াল দেখার পরই আরোহণের স্বপ্ন দেখেন। আধা-ডজন অভিযানের পরও সফলতা না আসায় এটি পরিণত হয় অনেকেরই অভীষ্ট লক্ষ্যে।

CHAMLANG_ANDY-HOUSEMAN_AAJ

ছবিঃ চ্যামলাং ইউএফও রুট (এন্ডি হাউজম্যান)

হোলচেক এবং জেনেক হ্যাক ২০১৯ এর বসন্তে এর কাছে পৌঁছালে ঋতুর কারনে সেখানে ছিল কম তুষার আর শক্ত বরফ। কোন প্রকার দূর্বলতাহীন এই দেয়ালে কোন প্রাকৃতিক আড়ালতো দূরে থাক, কোন ভালো বিভোয়াক করার জায়গাও নেই। ১৬ই মে তাঁরা হিমবাহ পেড়িয়ে ৫৩০০ মিটারে দেয়ালের গোড়ায় বিভোয়াক করে পরদিন এক ৮০মিটার ৭ এম.এম. দড়ি, ছোট বিভি তাঁবু, ৬টি আইস-স্ক্রু, ৫টি পিটন, ৫ দিনের খাবার, ৩টি গ্যাস কার্টিজ নিয়ে আরোহন শুরু করেন। নিচের অংশে আলগা পাথর, কঠিন মিক্সড ক্লাইম্বিং এবং ইস্পাত কঠিন বরফ তাঁদের লড়াই জমিয়ে তুলে। ২০ মে ৪র্থ দিনে তাঁরা পূর্ব রিজে উঠে সামিটের ৮০ মিটার নিচে ৪র্থ বিভোয়াক করেন। অবশেষে ২১শে মে তাঁরা শীর্ষ ছুঁয়ে দক্ষিণ রিজের জাপানী রুট দিয়ে নামার চেষ্টা করলেও নামতে তাঁদের লাগে আরো আড়াই দিন। সহজ মনে হলেও কার্যত দেখা গেলো এই পথ অনেক কঠিন। খাবার ছাড়াই আরো দুই রাত বিভোয়াক করে খারাপ দৃশ্যসীমার মাঝ দিয়ে তাঁরা ২৩শে মে নেমে আসেন গোড়ায়।

১৯৮১ সালে রেইনহোল্ড মেসনার, ডৌগ স্কট, আং দর্জি শেরপা এবং পাসাং শেরপা প্রথম চ্যামলাং এর উত্তর দিকে আরোহণ করে মধ্যবর্তী চূড়াগুলোর একটিতে পৌঁছেছিলেন। উঠার সময় তাঁরা রৌদ্রজ্জ্বল ঝলমলে আকাশে বক্স আকৃতির কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলেন। সেই অভিযানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই জুটি তাঁদের আরোহণ করা রুটের নাম রাখেন ইউএফও (আন-আইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট) লাইন।

এই অভিযান সম্পর্কে মেসনার বলেন “চ্যামলাং এর ইউএফও এক বুদ্ধিদীপ্ত রুট। একটি কঠিন দেয়ালে এক সুন্দর লাইন। তাঁরা যেভাবে এটি খুঁজে পেলো তা একটা শৈল্পিক নিদর্শন”।

চেক-প্রজাতন্ত্রের মারেক হোলচেক একাধারে পর্বতারোহী, রক-ক্লাইম্বার, ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার, লেখক, ফটোগ্রাফার এবং লেকচারার। তিনি আল্পাইন স্টাইলে এশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, এন্টার্কটিকা মিলে ৩০টির বেশী অভিযান করেছেন, যার মাঝে ১৩টি প্রথম সফল আরোহন। তিনি নেপালের তালুং (৭৩৪৮ মিটার) এ প্রথম আরোহণের জন্য ২০১৪ সালেও পাইওলেট ডি’অর পুরষ্কার এর জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি মেরু সেন্ট্রাল (৬৩১০ মিটার) আরোহনের জন্য গোল্ডেন পিটন এওয়ার্ড সম্মাননা পেয়েছিলেন। হোলচেকের দীর্ঘদিনের সহযোদ্বা চেক-প্রজাতন্ত্রের জেনেক হ্যাক নিজেও একজন পর্বতারোহী, রক-ক্লাইম্বার এবং স্কি-মাউন্টেনিয়ার।

টেঙ্গি রেগি টাও (৬৯৩৮ মিটার)

TENGI-RAGI_TAU-VILLANUEAVA_AAJ

ছবিঃ টেঙ্গী রেগি টাও ওয়েস্ট ফেইস (টিনো ভিল্লানুয়েভা)

২০১২ সালে হিমালয়ে প্রথম অভিযানে দুই আমেরিকান এলেন রুসো এবং টিনো ভিল্লানুয়েভা  নেপালের রাউলিং হিমালে টেঙ্গি রেগি টাও এর উত্তর রিজের “লাংমোচে রি” প্রথন সফল আরোহণ করেন। টেঙ্গি রেগি টাও এর পশ্চিম দেয়ালের নিচ দিয়ে চলাচলের সময় এর কাঠিন্য তাঁদের মুগ্ধ করে। তাঁরা ২০১৪ সালে এই দেয়াল আরোহনের চেষ্টা করলে সেযাত্রায় ৬৫০০ মিটার থেকে খারাপ আবহাওয়ার কারনে ফিরে যেতে হয়। পরের পাঁচ বছরে অন্যরা এই দেয়ালে আরো ব্যার্থ অভিযান করেন।

৫ বছর পর এই জুটি আবারো ফিরে এসে থামে থেকে শুরু করা এই অভিযানে লেগেছে মোট ৮ দিন। তাশি লাপচা পাস পেড়িয়ে ৩ দিন পর দ্রুলাম্বো হিমবাহে দেয়ালের গোড়ায় রাত কাটিয়ে এই দুই আমেরিকান প্রথম অংশ ড্রাই-টুলিং প্রক্রিয়ায় পেরিয়ে তুষারাবৃত অংশে পৌঁছান। এরপর ৩দিন বিভোয়াক করে তাঁরা ১৬০০ মিটারের এই কঠিন দেয়াল পেড়িয়ে ১৬ই অক্টোবর সামিটে পৌঁছান। একই পথে বিপদজনক রেপেলিং করে তাঁরা নেমে আসেন। উঠা-নামাতে তাঁদের লেগেছে ৫দিন-৪ রাত। এটি এই পর্বতে দ্বিতীয় সফল এবং আল্পাইন স্টাইলে প্রথম সফল আরোহন।

লিংক সর (৭০৪১ মিটার)

LINK-SAR_MATTEO-DELLA-BORDELLA_AAJ

ছবিঃ (A) চেঙী টাওয়ার (B) কে-৬ মেইন (C) লিংক সর দক্ষিন-পূর্ব ফেইস (ম্যাটিও ডেলা বোর্ডেলা)

পাকিস্তানের কারাকোরামের আরেক অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল ২০১৯ পর্যন্ত ৮টি ব্যার্থ অভিযানের সাক্ষী লিংক সর। পর্বতের কাঠিন্য বাদেও ভারত-পকিস্তান এর মধ্যকার বিবাদ এই পর্বত আরোহনের অনুমতি পাওয়ায় আরো কঠিন করে তুলেছিল। স্টিভ সোয়েনসন ২০০১ সালে প্রথম এই পর্বতে অভিযান করেন এক শক্তিশালী আমেরিকান দল নিয়ে। ওই যাত্রায় ব্যার্থ হয়ে তিনি আরো কয়েকবার অনুমতি চেয়েও না পেলেও ২০১৭ সালে ভাগ্য খুলে যায় – মিলে অনুমতি। ওই ধফা ক্রিস হোয়াইট এবং গ্রাহাম জিমারম্যানকে সাথে নিয়ে শীর্ষে পৌঁছাতে না পারলেও দেখতে পান একটা সম্ভাব্য পথ। এই ত্রয়ী মার্ক রিচিকে সঙ্গে নিয়ে আবারো ২০১৯ সালে আসেন সেই পথে অভিযানের লক্ষ্যে।

এডভান্সড বেসক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁরা ৬ দিন পর ৬ই আগস্ট সামিটে পৌঁছান। সামিটে পৌঁছানোর আগে এক ভয়াবহ ঝড়ে তাঁদের ৩৬ ঘন্টার বেশী আটকে থাকা লাগে। সামিটের দিন এক তুষারধ্বসে সাথে আনা সিড়ি ৩৫মি পরে গেলেও তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। এছাড়াও খাড়া দেয়ালে নরম, গভীর, অস্থিতিশীল তুষারের ঝামেলা তো ছিলোই। একই পথে নেমে আসতে তাঁদের লেগেছে দুই দিনের বেশী সময়। ওই অভিযাত্রীরা সফল হয়েছেন তাঁদের লেগে থাকার মনোভাব এবং এই ৪ জন আমেরিকানের সম্মিলিত ১২৬ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো এবং পার্টনারশিপ এর মূল অর্থ বুঝতে পারাতে।

রাকাপোশী (৭৭৮৮ মিটার)

RAKAPOSHI-NAKAJIMA_AAJ

ছবিঃ রাকাপোশী ২০১৯ লাইন (কেনরো নাকাজিমা)

পাকিস্তানের কারাকোরামের হুঞ্জা রিজিওমে অল্পের জন্য ৮০০০ মিটারের এলিট ক্লাবে নাম লেখাতে না পারা অনেক দারুন পর্বত রয়েছে।এদের মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম দেয়াল দিয়ে প্রথম আরোহণ হওয়া রাকাপোশী। কিন্তু এর দক্ষিণ-পূর্ব দেয়াল ছিল অজেয়।

৩৬৬০ মিটার উচ্চতায় হিমবাহে অবস্থিত বেসক্যাম্প স্থপন করে অস্থিতিশীল আবহাওয়ার মাঝেই কাজুয়া হিরাইডি এবং কেনরো নাকাজিমা দক্ষিণ দেয়াল ধরে অভিযোজনের অংশ এবং পথ কোথায় গিয়ে মিশেছে দেখার হিসেবে ৬১০০ মিটার পর্যন্ত উঠেন। দ্বিতীয় ধফায় বেরিয়ে গভীর নরম তুষারের সাগরের মাঝে দুঃসাধ্য পরিশ্রম করে তাঁরা ৩ দিনে ৬৮০০ মিটার উচ্চতায় তাঁবু স্থাপন করেন। সেখানেই খারাপ আবহাওয়ায় তাঁদের দুই দিন আটকে থাকতে হয়। এরপর আবহাওয়ার উন্নতি হলে তাঁরা আবারো আরোহণ শুরু করে  ২রা জুলাই সামিটে পৌঁছান এবং একদিনেই বেসক্যাম্পে নেমে আসেন। অন্যান্য তিনটি অভিযানের মতো এই রুট ততোটা কৌশলগতভাবে কঠিন না হলেও এর দৈর্ঘ্য এবং হিরাইডি ও নাকাজিমার দৃঢ়প্রত্যয় ও আরোহনের ধরন একে এনে দিয়েছে পাইওলেট ডি’অর সম্মান।

কাজুয়া হিরাইডি ২০০৯ সালে প্রথম এশিয়ান হিসেবে মাউন্ট কামেট আরোহণের জন্য পাইওলেট ডি’অর জিতেছেন। আর কেনজো নাকাজিমা’র ঝুলিতে আছে কে-সিক্স (২০১৩), কাকাবু রাজ্জি (২০১৪), লৌনবু কাংরি (২০১৬) এর মতো ঈর্ষণীয় সব পর্বত সামিট।

এই ৪টি অভিযান ছাড়াও বিশেষ সম্মাননা “গোল্ডেন আইস-এক্স” এর জন্য ক্যাথেরিন ডেস্টিভ্যাল নির্বাচিত হবার ঘোষণা এসেছে আগেই।

এবারের বিচারক মন্ডলীঃ

  • প্রথম অতিরিক্ত অক্সিজেন সহায়তা ছাড়া সবক’টি আটহাজারী পর্বত সামিটকারী নারী গার্লিন্ডে কাল্টেনব্রুনার।
  • ২০০৯ সালে কলঙ্ক (৬৯৩১ মিটার) এর নর্থ-ইস্ট ফেস আরোহণের জন্য পাইওলেট ডি’অর জয়ী জাপানী কাজুয়াকি আমানো।
  • ২০১৬ সালে তালুং আরোহণের জন্য পাইওলেট ডি’অর জয়ী রাশিয়ান নিকিতা বালাবানোভ।
  • ১৯৯০ সালে বোর্ডম্যান-টাস্কার এওয়ার্ড এবং ২০১৫ সালে স্যালুন ইন্টারন্যাশনাল ডু লিব্রে ডু মন্টাগ্নে জয়ী স্কটিশ ভিক্টর সাউন্ডার্স।
  • ২০১৮ সালে পাইওলেট ডি’অর জয়ী হেলিয়াস মিলারিউক্স।
  • ১৯৮০-৯০ এর দশকের অন্যতম শীর্ষ আল্পাইনিস্ট এনিরিকো রোসো।
  • ২০১৯ এ পাইওলেট ডি’অর জয়ী এলেক্স চেজেন।
  • ২০১৪ সালে পাইওলেট ডিওর জয়ী রাফায়েল স্লাউনস্কি।

তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ পাইওলেট ডি’অর, উইকিপিডিয়া, প্ল্যানেট মাউন্টেইন সহ আরো গুটিকয়েক ওয়েবসাইট।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *