পাহাড়ের হিমশীতল কন্যা

Share

২০ই জানুয়ারী, ২০১৮ এলেক্স জিকন পুমোরি’র (৭,১৬১ মিটার) সামিটে পৌঁছান, সাথে ছিলেন পাকিস্তানের আলী সাদপারা এবং নেপালের নুরি শেরপা ও তেম্বা ভোটে। এই দ্রুত আরোহণটি ছিল এলেক্সের অক্সিজেন ছাড়াই শীতকালীন এভারেস্ট আরোহনের প্রচেষ্টার অভিযোজন প্রক্রিয়ার অংশ। মূল উদ্দেশ্য না হলেও, শীতকালে পুমোরি আরোহন সহজলভ্য কিছু নয়। কৌশলগত কাঠিন্যের দিক থেকে ভয়ানক না হলেও, ঠান্ডা এবং উচ্চতা এই সময় আরোহণকে করে তোলে কঠিনতর হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে, শীতকালে তাদের আগে মাত্র একটি দলই পেরেছিল সামিটে পৌঁছাতে। ১৯৮২ সালের ৬ই জানুয়ারি জিম ব্রিডওয়েলের নেতৃত্বে নেড জিলেট এবং জন রেইনল্ডস পুমোরি’র সামিটে প্রথম শীতকালে পৌঁছানোর ইতিহাস গড়েন।

1

ছবিঃ পুমোরি সামিটে এলেক্স জিকন

ম্যালরি’র “পাহাড়ের কন্যা”…

পুমোরি (যার অর্থ শেরপা ভাষায় “পাহাড়ের কন্যা”) এই নামটি রাখেন কিংবদন্তি জর্জ ম্যালরি। তিনি কখনও কখনও এই পর্বতকে নিজের মেয়ে ক্লেয়ারের নামানুসারে “ক্লেয়ার পিক”নামেও ডাকতেন। নেপাল-তিব্বত সীমান্তের মহালঙ্গুর হিমালের ৭১৬১ মিটার (২৩৪৯৪ ফুট) উচ্চতার পুমোরি এভারেস্টের কোল ঘেঁষে মাত্র ৮ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত। শেরপারা এর রূপে মুগ্ধ্ব হয়ে একে এভারেস্টের মেয়ে নামেও অভিহিত করেন। ১৯৬২ সালের ১৭ই মে জার্মান-সুইস অভিযানের জারহার্ড ল্যান্সার প্রথম এর শীর্ষে পা রাখেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এরই পর্বতে প্রথম শীতকালীন অভিযান হয় প্রথম সামিটের আগেই! ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে সুইস ওয়াল্টার স্টুবল এবং জার্মান গেরড মেহল, সঙ্গে নয়টি শেরপা সহ এই অভিযানে আসেন। কিন্তু ৭ই ডিসেম্বর এই অভিযানের দুঃখজনক সমাপ্তি ঘটে। ৬৩০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছানোর পর এক দুর্ঘটনায় স্টুবল এবং এক শেরপা মারা যান।

ব্রিডওয়েলের প্রথম শীতকাল…

৮২ এর শীতকালে জিম ব্রিডওয়েলের নেতৃত্বে পুমোরি’র পাদদেশে পৌঁছান আমেরিকার নেড জিলেট, জন রেইনল্ডস এবং স্টিভ ম্যাককিনি। এই বিখ্যাত পর্বতারোহী তাঁর অভিযানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পুমোরিকে “বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পর্বত” হিসাবে বর্ণনা করেন।

Jim_Bridwell,_Salt_Lake_Trade_show,_about_1990

ছবিঃ জিম ব্রিডওয়েল

ব্রিডওয়েল এবং তার সঙ্গীরা প্রথমে পর্বতের পূর্বদিকে মূল আইসফলের ডানদিক দিয়ে একটি নতুন রুটে আরোহনের চেষ্ঠা করেন। কিন্তু  খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় তাঁদের ৬,৭০০ মিটার থেকে নেমে আসতে হয়। তারপর তাঁরা বেসক্যাম্পে তিন দিনের জন্য বিশ্রাম নেন। এই বিরতিতে ম্যাককিনি বাড়ির পথ ধরেন এবং তাঁর জায়গায় দলে যোগ দেন ক্রেইগ কলোনিকা।

অত:পর ১৯৮২ সালের ৬ই জানুয়ারি জিম ব্রিডওয়েল, জন রেইনল্ডস এবং নেড জিলেট প্রথমবারের মতো শীতকালে পুমোরি’র শীর্ষে পৌঁছান। ব্রিডওয়েল বলেন, “আমরা ৬৩০০ মিটারে একটি ক্যাম্প এবং ৬৬৫০ মিটারে উত্তর-পূর্ব রিজে আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে পূর্বের দিকে দিয়ে আরোহন করি। শেষ ৫০০ মিটার আমরা উত্তর-পূর্ব দিক দিয়েই এগিয়ে যাই। এই রুট কঠিন হলেও আমরা ঠিকে যাই। এই শেষ ধাপে আমাদের সময় লেগেছিল সাতদিন।”

 ছয় ব্যর্থ প্রচেষ্টা…

১৯৮২ সালের প্রথম আরোহন এবং জিকোনদের দ্বিতীয় সফল আরোহনের মধ্যে ৩৫ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তা যে চেষ্টার অভাবে ছিল তা কিন্তু ভাবার অবকাশ নেই। এই দীর্ঘ বিরতির মধ্যে হয়ে গেছে আরও ছয়টি ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

এরমধ্যে আটজন আমেরিকান ও অস্ট্রেলীয় পর্বতারোহীদের দ্বারা গঠিত প্রথম অভিযান ১৯৮৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর একটি ট্র্যাজেডি দ্বারা শেষ হয়। এর মাত্র চারদিন আগে তাঁরা বড়দিনে বেসক্যাম্পে পৌঁছেছিলেন  এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আরোহনের প্রথম দিনেই ৫৮০০ মিটার উচ্চতা থেকে অস্ট্রেলিয়ার জর্জ কারি পতনের পর মারা যান। একই সময়ে, অ্যান্টোন স্টোকারের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি অভিযান ৬৭৫০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছালেও সিরাক ও ফাটলের ভয়াবহতা উপলব্ধী করে তাঁরা অভিযান বাতিল করেন।

পরবর্তী দুটি প্রচেষ্টা ছিল জাপানিদের। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে শিনজি সাসোকা একাই একটি চেষ্টা করেন। কিন্তু ৬৭০০ মিটার এ খুব বড় একটি ফাটলের মুখোমুখি হয়ে ফিরে আসেন। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে, ভারী তুষারপাত এর কারনে ৬৩০০ মিটার পৌঁছানোর পরে, শিনজি তাকাহাশি, নবুতেরু কাওয়াহারা এবং ইয়ুশিতোমু মিয়োশির দল ফিরে আসেন।

২০০৫ সালের ১৪ই জানুয়ারি ভ্লাদিমির বেলাসোভের নেতৃত্বে ৫ রাশিয়ান পর্বতারোহীদের একটি অভিযানও অতিরিক্ত ফাটল, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং সময়ের অভাবের জন্য ৬৩০০ মিটার হতে ফিরে আসেন। ২০০৮ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি দলের শেরপা নিমা গেলজেন তুষারধ্বসের উচ্চ ঝুঁকির মুখোমুখি হয়ে আর এগুতে অস্বীকৃতি জানালে হার্ভ অর্গেনসনের নেতৃত্বাধীন ফ্রেঞ্চ দল ৬৪০০ মিটারের বেশি এগুতে পারেননি।

জেফ লোয়ে, ক্রিস্টোফ প্রফিট এবং “প্রশাসনিক” শীত…

অন্যদিকে, নেপাল কর্তৃক জারি করা শীতকালীন পারমিট বিবেকনায় আরও অন্তত আটটি অভিযান চলেছে। এটা মনে রাখা জরুরী যে নেপালি কর্তৃপক্ষ ক্যালেন্ডারের তারিখগুলির সাথে সামঞ্জস্যহীনভাবে, মধ্য নভেম্বর ও মধ্য ফেব্রুয়ারির মাঝখানে পরিচালিত অভিযানকে শীতকালীন অভিযান বিবেচনা করে। এটাকে “প্রশাসনিক” শীত বলা হয়

সম্ভবত, তাদের সব থেকে সবচেয়ে অসামান্য অভিযান ছিল জেফ লোয়ে  পরিচালিত অভিযান, যিনি ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে একান্তে সামিটে পৌঁছান, এবং এরপর তাঁর সহযাত্রী আর্ল উইগিন্সকে অতি-উচ্চতা জনিত অসুস্থতার কারনে উদ্বার করতে হয়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য অভিযান ছিল ১৯৯৬ এর ডিসেম্বরে ক্রিস্টোফ প্রফিটের নেতৃত্বে অভিযান। পহেলা ডিসেম্বর ক্রিস্টোফ প্রফিট এবং জিয়ান ব্লানচার্ড দক্ষিণ-পূর্ব দিকের নিয়মিত রুট দিয়ে সামিটে পৌঁছান। পরবর্তীতে, ক্রিস্টোফ প্রফিট, স্যামুয়েল বয়েজী, অলিভিয়ার বেসন এবং পিয়েরে আন্দ্রে রেম দক্ষিণ পিলারের মুখোমুখি হতে বেসক্যাম্পের মুখ ঘোরান, যা ১৯৭২ সালের প্রথম আরোহনের পর আর পুনরাবৃত্তি হয়নি। তাঁরা ডানদিকের একটি আইস করিডোর দিয়ে দক্ষিণ পিলার থেকে বেরিয়ে যান। এরপর পাথরের খাড়া দেয়ালে অত্যন্ত টেকনিক্যাল ক্লাইম্ব করে তাঁরা গাই ডিসেম্বর আবারো শীর্ষে পৌঁছান। তাঁরা কোন দড়ি ফিক্স করেননি, উচ্চতায় তাঁবু স্থাপন করেননি এমনকি ব্যবহার করেননি কোন শেরপা।

__________________________সমাপ্ত_______________________________

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *