টমাস ম্যাকিউইক্স, যার পরিচিতি টোমেক নামে এবং ডাক নাম চাপকিন্স, নাঙ্গা পর্বত এর ঢাল থেকে আর কোনোদিন নামবেন না, উঠবেন না আর কোন পর্বতে। এই পর্বতের ৭০০০ মিটারের উঁচুতেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভাল মুহূর্তগুলোতে কাটিয়েছেন এবং এই পর্বতের ৭০০০ মিটারের উঁচুতেই তিনি এই সপ্তাহে মারা গেছেন মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। জীবনে কোন আটহাজারী পর্বত সামিট ছিলোনা, নেই কোন গ্রীষ্মে অথবা বসন্তে অভিযান, আছে শুধুই এই একটি পর্বতকে ভালবাসার গল্প। অত্যন্ত শক্তিশালী পর্বতারোহী সাধারণ মৌসুমে যেকোন আটহাজারী শৃঙ্গ আরোহণের ক্ষমতা রাখতেন। তবুও তিনি সাতবার ফিরে গেছেন নাঙ্গার কোলে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে পূরণ করলেন নিজের স্বপ্ন। এযেনো সেই অধ্যাবসায়ী মাকড়সার গল্পের রবার্ট ব্রূস, যে হারতে হারতেই জয়ী হয়। এযেনো কোন প্রেমের উপন্যাস, যার শেষটা হয় ট্রাজেডীর।
জটিল যৌবন…
তিনি ১৯৭৫ সালের ১২ই জানুয়ারি পোল্যান্ডের ওয়ারশ থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জিওসজিন (লোজ প্রদেশ) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৬০০০ বাসিন্দার এই ছোট্ট শহরে তিনি শৈশব কাটান। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে তাঁকে যেতে হতো প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে চেস্টোশোয়া শহরে।
তিনি এক জটিল যৌবনকাল কাটিয়েছিলেন। হেরোইনের আসক্তিতে ডুবে থাকেন বেশ কয়েকবছর। নেশার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনতে তাঁর বোন তাঁকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেন। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ফিরলেও অল্প কিছুদিনেই আবার ফিরে যান সেই নেশার অন্দ্বকার জগতে। ভাইকে এভাবে হারিয়ে যেতে দেখতে পারছিলেন না তাঁর বোন মেলগোর্জাটা। তিনি টোমেককে আবারো নিয়ে আসেন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। এবার সত্যিকারের মুক্ত মানব হয়ে ফিরে আসেন টোমেক।
হিচহাইকিং…
ভাবুক ও উদাসীন টোমেকের এরপর চাপে হিচহাইকিং এর নেশা। সিনেমায় আমরা মাঝেমাঝে হাইওয়েতে তরুণতরুণীর হাত আড়াআড়ি এগিয়ে বৃদ্বাঙ্গুলি দেখিয়ে অপরিচিত গাড়ি থেকে লিফট চাইতে দেখে থাকি। এভাবে লিফট নিয়ে এক স্থান থেকে আরেকস্থানে ঘুরে বেড়ানোকেই বলে হিচহাইকিং। হিচহাইকিং করে সারা বিশ্ব ভ্রমণের নেশায় বেরিয়ে পড়েন টোমেক. এভাবে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পড়েন ভারতে. ভারতে ভ্রমণের সময় তিনি জীবদয়া মিশন পরিদর্শন করেন, যেখানে তিনি ডাঃ হেলেনা পাইজকে কুষ্ঠরোগী শিশুদের যত্নে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। এই মিশনে কাজ করার সময়ে ভারতের সুউচ্চ পর্বতমালা তাঁকে আকৃষ্ট করা শুরু করে। তিনি এই মুহূর্তকেই নিজেই নিজের রূপান্তরের মুহূর্ত বলে চিহ্নিত করেছিলেন এবং পর্বতের সাথে সখ্যতার শুরু এখান থেকেই হয়েছিল।
সেই সময়ে তার গন্তব্যস্থলগুলির আরেকটি ছিল আয়ারল্যান্ড। সেখানে তিনি প্রথম মারেক ক্লোনস্কি’র সাথে পরিচিত হন, যার সাথে তিনি প্রথম বড় কোন পর্বত অভিযান করেন। পোল্যান্ড ফিরে আসার পর, তিনি একটি উইন্ডমিল স্থাপনে বিশেষায়িত কোম্পানীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যক্তি জীবন…
ব্যক্তি জীবনে টোমেক দুইবার বিয়ে করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে আছে দুই সন্তান এবং দ্বিতীয় স্ত্রী আনা সোলস্কার ঘরে এক সন্তান। তিনি আনা ও ৩ সন্তান শোঃ গত পাঁচবছর আয়ারল্যান্ডে বসবাস করতেন।

ছবিঃ তিন সন্তানের সাথে টোমেক
প্রথম অভিযান…
২০০৮ সালে, তিনি তাঁর প্রথম বড় আল্পাইন কীর্তি গড়েন। মারেক ক্লোনস্কিকে সাথে নিয়ে তিনি উত্তর আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় এবং কানাডার ছাদ বলে পরিচিত মাউন্ট লোগান ক্রস করেন। এই অভিযানের কারণে তাঁরা ওই বছর এডভেঞ্চার জগতে অবদানের জন্য পোল্যান্ডের সর্বোচ্চ পুরস্কার “কোলোস্সি এওয়ার্ড” অর্জন করেন। ২০০৯ সালে তিনি ৭০১০ মিটার উচ্চতার “খান তেংড়ি” পর্বত সোলো সামিট করেন, যা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
অতঃপর নাঙ্গা পর্বত…
নাঙ্গা পর্বতে গত সাতটি শীত ধরে টোমেকের অভিযানের কারণে তাঁর ২০১৪ সালের অভিযানের সঙ্গী জার্মান ডেভিড গোটলার টোমেককে আখ্যায়িত করেন “শীত পাগল তরুণ” হিসেবে। যারা তাঁর সাথে পাকিস্তানে শীতকালীন অস্বস্তিকর অভিযানে অংশ নিয়েছেন তাঁদের মতে অন্যরা যখন ঠান্ডায় নিজেদের ডাউন-জ্যাকেট খোলার সাহস রাখেন, তখন টোমেক শর্ট স্লিভ গেঞ্জি পরে দিব্যি ঘুরে বেড়াতেন। তিনি ছিলেন চরম ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক কঠিন মানুষ, যার ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি প্রতিহত করার ক্ষমতা। তিনি যেন ছিলেন অন্য গ্রহের এক পর্বতারোহী, এক সত্যিকারের ইয়েতি।
তাঁর জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁর জীবনের প্রায় প্রতিটা অভিযানই কোন স্পনসর নয়, বরং সাধারণ মানুষের ভালোবাসার টাকায় অর্থাৎ “ক্রাউড ফান্ডিং” থেকে আসা অর্থে সংগঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, টাকা না থাকায় একাধিকবার তিনি পাকিস্তানে শুধুমাত্র আসার টিকেট দিয়ে ভ্রমণ করেছেন, প্রত্যাশা ছিল যে অভিযান শেষে পাকিস্তানে কোন একটি চাকরি করে দেশে ফেরার টিকেট কেনার অর্থ জোগাড় করতে পারবেন।

ছবিঃ নাঙ্গা পর্বত
২০১০-১১ এর শীতকালে টোমেক ম্যাকিউইক্স এবং মারেকে ক্লোনস্কি প্রথম পোলিশ “জাস্টিস ফর অল” অভিযান করেন এবং বেছে নেন ডায়ামির ঢালের কিনসোফার রুট। তাদের প্রথম আটহাজার মিটার উচ্চতার পর্বতাভিযানে তাঁরা খারাপ আবহাওয়া এবং তুষারধ্বসের ঝুঁকির কারণে ৫৫০০ মিটার উচ্চতাতেই অভিযান সমাপ্ত করেন।
২০১১-১২ এর শীতে, এই দুই বন্দ্বু আবারো ফিরে আসেন ডায়ামির ঢালে। এবার তাঁরা যোগ দেন ডেনিস উরুবকো এবং সিমোনে মোরো’র সাথে। এবারে কিনসোফার রুট হয়ে উঠে আরো অপ্রতিরোধ্য। দুই পোলিশ আবারো ৫৫০০ মিটার থেকেই বাড়ি ফিরেন।
২০১২-১৩ এর শীতকালে নাঙ্গা পর্বতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল, প্রথম শীতকালে সামিটের ইতিহাস গড়তে পর্বতে আসেন অনেক অভিযাত্রী। ৪টি অভিযানের দুইটি করে দল পর্বতের দুই ঢালে আরোহনের চেষ্টা করেন। টোমেক এবং ক্লোনস্কি এবার ডায়ামির ফেসের পরিবর্তে আসেন রূপাল ফেসের শেল্ রুটে। এবার ধৈর্য ধরে এগুতে থেকে শেষ পর্যন্ত সামিট পুশ শুরু করেন টোমেক একাই। তিনি এইবারে অতিক্রম করেন ৭৪০০ মিটার যা তখন পর্যন্ত নাঙ্গা পর্বতের ইতিহাসে শীতকালে অতিক্রান্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতা।
২০১৩-২০১৪ এর শীতকালে আসে আরও চার অভিযাত্রী দল। পোলিশ “জাস্টিস ফর অল” অভিযানে রূপাল ফেসের বেসক্যাম্পে আসে ছয় সদস্যের দল। তাঁদের তিনজনই ছিলেন এই পর্বতে শীতকালে অভিজ্ঞ (টোমেক ম্যাকিউইক্স, মারেক ক্লোনস্কি এবং জ্যাক টেলের) এবং তিন নতুন সংযোজন (পাওয়েল ডুনাজ, মাইকেল ওবরিকি এবং মাইকেল জিকোস্কি)। তাঁরা বেসক্যাম্পে প্রায় ৯০ দিন অবস্থান করেন এবং শীতকালের শেষে এক তুষারধ্বস তাঁদের তাড়িয়ে দেয়ার আগে পর্যন্ত লেগে ছিলেন। তাঁরা সিমোন মোরো পরিচালিত অভিযানের সাথে একত্রিত হন. মোরো, টোমেক এবং গোটলার শীর্ষে পৌঁছার শেষ চেষ্টা শুরু করেন, যাতে তাঁরা ৭২০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছান, যা তখন পর্যন্ত এই পর্বতে শীতকালের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতা।
২০১৪-১৫ এর শীতকালে, টোমেক সঙ্গী পরিবর্তন করে ডেনিয়েল নার্ডি ও এলিজাবেথ রেভোলের সাথে গেলেন। নার্ডি বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছানোর আগেই, টোমেক এবং এলিজাবেথ জানুয়ারির মাঝামাঝি একটি শুরু করেন। সেই যাত্রায় তাঁদের ডায়ামির ফেসের ৭৮০০ মিটার পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয়।
২০১৫-১৬ সালের শীতকালে এলেক্স জিকন, আলী সাদপাড়া এবং সিমোন মোরো ২০১৬ সালের ২৬ই ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো শীতকালীন নাঙ্গা পর্বত সামিটের ইতিহাস গড়েন। টোমেক এবারও এলিজাবেথ রেভোলের সাথে আসেন এবং উভয়ই ২০০০ সালের রেইনহোল্ড মেসনার-হানসপিটারের অসমাপ্ত রুটে প্রচেষ্টায় প্রায় ৭৪০০ মিটার পৌঁছান। টোমেকের ফান্ড ফুরিয়ে গেলে তিনি বেসক্যাম্পে অসহায় অবস্থায় পরে যান। পরে সহযাত্রী আরসালান আহমেদ আনসারী অনলাইন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে টোমেকের জন্য দেশে ফেরার অর্থ যোগাড় করেন। অর্থ সাহায্য পেয়ে ফিরে যাবার সময় গুঞ্জন উঠেছিল টোমেক আরেকবার চেস্টার জন্য বাড়ি না ফিরে বেসক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু শেষ মুহুর্তে তিনি সিদ্বান্ত পরিবর্তন করে বাড়ীর পথ ধরেন এবং সেই সাথে নাঙ্গা পর্বতের সবচেয়ে পুরোনো যোদ্বা পরিণত হোন ট্রেজিক হিরোতে। কারন তিনি ফেরার সিদ্বান্ত নেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই রচিত হয় নাঙ্গা জয়ের গল্প। এরপর দেশে ফিরে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন যে তিনি আর নাঙ্গা পর্বতে ফিরে আসবেন না।

ছবিঃ ২০১৫-১৬ এর অভিযানে টোমেক
২০১৭-১৮ সালের শীতের শুরুতে একদিন টোমেক খুলে বসলেন ক্রাউড ফান্ডিং ক্যাম্পেইন। কিছু অর্থের ব্যবস্থা হতেই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পুরোনো সঙ্গী ফ্রান্সের এলিজাবেথ রেভোলকে নিয়ে চলে এলেন পাকিস্তান। ২৬শে জানুয়ারি বহুল প্রতিক্ষীত সামিট শেষ করে ফেরার সময় টোমেক আক্রান্ত হন অতি উচ্চতাজনিত অসুস্থতায়, হয়ে যান স্নো ব্লাইন্ড এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফ্রস্টবাইট আক্রান্ত। এলিজাবেথ ৮০০০ মিটারের কাছাকাছি থেকে ৭৩০০ মিটারের দিকে নামিয়ে আনেন টোমেককে। এরপর নিজের অবস্থা আরোও খারাপ হওয়ায় এলিজাবেথ একাই নামতে শুরু করেন। পোলিশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত উদ্বার অভিযানে উরুবকো এবং বিয়েলকি, “আইস ওয়ারিয়র্স” দের দুই শীর্ষ নাম খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও কল্পনাতীত দ্রুতবেগে আরোহন করে ৬২০০ মিটার উচ্চতায় এলিজাবেথ রেভোলকে উদ্বার করেন। সাথে সাথে ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী এই উদ্বারকারী দল জানিয়ে দেন টোমেক অনেক উপরে আছেন এবং এই খারাপ আবহাওয়ায় তাঁর কাছে পৌঁছানো অসম্ভব। এলিজাবেথ নিশ্চিত করেছেন মৃত্যুর আগে টোমেকের আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়। স্যার রেইনহোল্ড মেসনারের ২০০০ সালের অসমাপ্ত রুট সম্পূর্ণ করেছেন টোমেক-এলিজাবেথ জুটি। এরা ২৬শে জানুয়ারি সামিটে পৌঁছেন। মাঝের একবছর বাদ দিয়ে আবারো ফিরলেন, কঠিনতম এক রুট আরোহন করলেন, অক্সিজেন ও শেরপা সাহায্য ছাড়াই সামিট করলেন। এরপর নির্ধারিত হয় টোমেকের নাঙ্গা পর্বতের সাথে চিরমিলনের নিয়তি। সব বিখ্যাত প্রেমগাঁথা গুলোর শেষটা কেনো জানি বিয়োগান্তকই হয়! এই কিলার মাউন্টেইনের কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে নাঙ্গা পর্বতের সাথে টোমেকের প্রেম যেনো পেলো অমরত্ব।
***সমাপ্ত***

Recent Comments