পর্বতপ্রেমীদের কাছে কারাকোরামের পঞ্চরত্নের আবেদন সবসময় ভিন্ন। পাকিস্তানে অবস্থিত কে-২, নাঙ্গা পর্বত, গাশারব্রূম-১, ব্রডপিক এবং গাশারব্রূম-২ কে কারাকোরামের পঞ্চরত্ন নামে ব্লগ টাইটেলে অবিহিত করা হলেও নাঙ্গা পর্বতের অবস্থান হিমালয়ান রেঞ্জে। হিমালয়ের বসন্ত মৌসুম শেষ হলেই সকলের নজর গিয়ে পরে এই পঞ্চরত্নের উপর। কারন মূলত কারাকোরামের ক্লাইম্বিং মৌসুম শুরু হয় জুলাই থেকে। তাই জুনের শুরু থেকেই বিশ্বের সব নামীদামী পর্বতারোহীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে পাকিস্তান। আর কারাকোরাম! সে তো মুখিয়ে থাকে পর্বতারোহীদের সামর্থের শেষ বিন্দু পর্যন্ত পরীক্ষা নেয়ার জন্য। কারাকোরামের ক্লাইম্বিং এর সবচেয়ে ভয়ানক দিক হচ্ছে এর আবহাওয়া, যা প্রতিনিয়ত ক্লাইম্বারদের উপহার দিয়ে যায় বিস্ময়।

শুধু কী প্রকৃতির বিমাতা সূলভ আচরন! নাহ, আরো উপসর্গ আছে কারাকোরামে পর্বতারোহণে। নেপালে যেখানে রয়েছে পর্বতারোহণের শুরুর সময়কাল থেকে সাপোর্ট দিয়ে আসা প্রশিক্ষিত শেরপা’র দল, সেখানে পাকিস্তানে রয়েছে অল্প কিছু সংখ্যক হাই-অল্টিচ্যুড-পোর্টার (HAPs নামে যাদের পরিচয়)। পর্বত শিখরে পৌঁছানো তো অনেক পরের কথা বেসক্যাম্পে পৌঁছানোই তো মোটামুটি এক এক্সপিডিশন। এভারেস্ট বেসক্যাম্পে যেতে যেখানে আপনাকে ট্রেক করতে হবে ৩০ মাইল, সেখানে কে-২ বেসক্যাম্পে যেতে ট্রেক করতে হবে ৮০ মাইল। হেলি-রেস্কিউ’র সুবিধাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আর্মি পরিচালিত হেলি-রেস্কিউতে খরচ হয় ৩০ হাজার ডলার, যেখানে হিমালয়ে খরচ ৫ হাজার ডলার। এসবের পরেও রয়েছে পাকিস্তানীর বিখ্যাত (!) কূটনৈতিক জটিলতা। প্রায়শই দেখা যায় সব প্রস্তূতি শেষ, পারমিট কেনাও হয়ে গেছে, পাকিস্তান এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনও শেষ, এরপরই ইসলামাবাদ জানিয়ে দেয় যে পর্বতারোহীকে দেশে ফিরে যেতে হবে। হাই-অল্টিচ্যুড-পোর্টারদের প্রমোট করতে শেরপাদের আগমনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে জারী করা নিয়মাবলী অবস্থাকে আরো কঠিন করে তুলেছে। এবারের মৌসুমের কথাই ধরুন। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের নারী ক্লাইম্বার ক্রিস বুর্কে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন লাকপা শেরপা’র সাথে। একসাথে করেছেন ৯টি হিমালয়ান ক্রাউন জয়। তাঁর মধ্যে রয়েছে গাশারব্রূম-১, ২ এবং কে-২। নিজের এইবন্ধুকে নিয়ে এবার চড়তে চেয়েছিলেন ব্রডপিক। পারমিট নেয়াই ছিল, ইমিগ্রেশনও শেষ। কিন্তু এরপরই পাকিস্তানের হর্তাকর্তাদের এক সিদ্বান্তে তাকে ফিরে আসতে হয় নেপাল। বুর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন ‘আমি যেনো আটহাজারী পর্বত ক্লাইম্বের আগেই এক আটহাজারী পর্বত আরোহণ করে ফেলেছি’।

জুলাইয়ের শেষ নাগাদ সাধারণত শেষ হলেও এবার কারাকোরামের গ্রীষ্মকালীন ক্লাইম্বিং মৌসুম একটু প্রলম্বিত হলো। অসাধারন কিছু ক্লাইম্বিং এর পরও এই গ্রীষ্মে এই পঞ্চরত্নে ২২১টি অনুমতির বিপরীতে মোট সামিট হয়েছে মাত্র ২৩টি (সাফল্য ১০.৪১%)। সময়ের সেরা কিছু আল্পাইনিস্টদের আগমনের পরও এই পরিসংখ্যান থেকেই কিছুটা হলেও বোঝা যায় কি এই কারাকোরাম! চলুন দেখে নেয়া যাক কেমন ছিল এবারের মৌসুম। ব্লগটি একটু বড়ই বলা চলে, তাই একটু সময় নিয়েই বসে পড়ুন। হ্যাপি রিডিং…
কে-২ (৮৬১১ মিটার) কারাকোরামে মৌসুম শুরু হবে আর কে-২ আলোচনায় থাকবেনা এটা হতেই পারেনা। ২০১৪ সালে ৩০-৪০ জন সামিট করার পর থেকেই কারাকোরামে মৌসুম শুরু হলেই মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয় ‘কে-২ কী হতে চলেছে পরবর্তী এভারেস্ট!’। পশ্চিমা দেশগুলোর শীর্ষ অপারেটরদের কে-২ তে এভারেস্ট স্টাইলে এক্সপিডিশন চালানোর জন্য ক্লায়েন্ট নিয়ে আসায় মূলত মিডিয়ার এই মাথা ব্যাথার কারন। কিন্তু কে-২ ২০১৫ এবং ২০১৬ সাল দুইবারই সব অভিযাত্রীদের শূণ্য হাতে ফিরিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সে আরেকটি এভারেস্ট কখনোই হবেনা। এভারেস্টের সেই স্নো-ওয়াকে যেখানে একমাত্র প্রতিপক্ষ হচ্ছে উচ্চতা, সেখানে কে-২ তে অল্টিচ্যুড ছাড়াও বাধা হয়ে দাঁড়ায় সত্যিকারের ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জ। একজনকে হতে হয় আইস ক্লাইম্বিং এবং রক ক্লাইম্বিং এর এক্সপার্ট। এসব টেকনিক্যাল কাঠিন্যের জন্য কে-২ নিজেই তৈরী করেছে নিজের এক গা ছমছম করা ইমেজ। মাউন্টেনিয়ারিং ওয়ার্ল্ডে একটা কথা প্রচলিত আছে…“এভারেস্ট সামিট করো, তুমি পাবে দম্ভোক্তি করার অধিকার। কে-২ সামিট করো, তুমি অর্জন করবে সম্মান।”
জুনের মাঝামাঝি হতে টিমগুলো কে-২ বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছাতে শুরু করে। ১০ই জুলাই ৭৩০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প-৩ পর্যন্ত রোপ ফিক্সড হয়ে যায়। সাধারনত বড় এক্সপিডিশনগুলোর শেরপা এবং পাকিস্তানী হাই-অল্টিচ্যুড-পোর্টার এর দল মিলে এই কাজ করে থাকেন। ১৪ই জুলাই হতে ১৬ই জুলাই পর্যন্ত একটা ছোট ওয়েদার উইন্ডোতে সামিটের লক্ষ্যে উচ্চভিলাষী ক্লাইম্বাররা খারাপ ওয়েদারের ভিতরই সামিট পুশ শুরু করে ১০ ই জুলাই। ৭০ এর বেশী ক্লাইম্বারের ভীড়ে কে-২ তে সৃষ্টি হয় ট্রাফিক জ্যাম বিশেষ করে ‘হাউজেস চিমনী’ নামক টেকনিক্যাল সেকশনে। গতি শ্লথ হলেও ১২ই জুলাই ক্লাইম্বাররা ক্যাম্প-৩ তে এসে পৌছান যে সময় শেরপারা ক্যাম্প-৪ পর্যন্ত রোপ ফিক্সিং করছিলেন। কিন্তু যেই জায়গায় সামিট উইন্ডো পাওয়ার কথা সেখানে ১২ই জুলাই থেকে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। সম্পূর্ণ হোয়াইট আউটের মধ্যে সবাই ক্যাম্প-৩ থেকে বেসক্যাম্পে নেমে আসেন। আবার শুরু হয় অপেক্ষা। ভবিষ্যতবাণী জানান দিচ্ছিলো জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আবহাওয়া আবারো সুযোগ দিতে পারে। ওই সময়কে লক্ষ্য করে কেউ কেউ ২১ই জুলাই বেসক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে আগেই উঠে আসেন ক্যাম্প-২ তে। এই সময় আসে আরেক দূর্যোগ। ২৩ই জুলাই এক ভয়ানক হিমবাহ ধ্বস ক্যাম্প-৩ সম্পূর্ণ ধ্বসিয়ে দেয়। টেন্ট, রসদ কিছুই বাকী ছিলনা সেখানে। গিয়ার্সের ভান্ডারও উড়ে গিয়ে পরেছে কয়েক হাজার ফিট নিচের গ্লেসিয়ারে। সব উড়িয়ে নিয়ে গেলেও ভালো দিক ছিল যে কোন ক্লাইম্বারের কোন ক্ষতি হয়নি। সব রসদ হারিয়ে কমার্শিয়াল এক্সপিডিশনগুলো তখনই অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও পর্বতারোহীদের কয়েকজন অপেক্ষার সিদ্বান্ত নেন। পরে সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁরাও জুলাইয়ের শেষের দিকে ঘোষণা করে অভিযানের সমাপ্তি। এরই সাথে নিশ্চিত হয়ে যায় স্যাভেজ মাউন্টেইন আরো একবার আন-ক্লাইম্বড থাকার পরিণতি।

মোহাম্মদ আলীর ক্যামেরায় হিমঅবাহ ধ্বসের আগেও পরে ক্যাম্প-৩
নাঙ্গা পর্বত (৮১২৬ মিটার)
২০১৩ সালে ডায়ামির বেসক্যাম্পে তালেবান হামলায় ১০ জন বিদেশী ক্লাইম্বার নিহত হওয়ার পর ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে কোন পারমিট ইস্যু না করলেও এবার মৌসুমের ৯ই জুন থেকেই ক্লাইম্বাররা বেসক্যাম্পে আসা শুরু করেন। প্রথমেই বলতে হয় স্পেনীশ টিম ইয়ান্নিক গ্রাজিয়ানী, টম সেইডেন, ফেররান লাটোররে এবং হেলিয়াস মিলারিওক্স এর কথা। এই টিমের লক্ষ্য ছিল উত্তর দিকে স্যার রেইনহোল্ড মেসনারের ২০০০ সালে চেষ্টা করা অসমাপ্ত লাইন সমাপ্ত করার। লাটোররে’র ব্যক্তিগত একটা লক্ষ্যও ছিল। ২০০৮ সালে শাইনিং ওয়াল ক্লাইম্ব করা এবং ১২টি হিমালয়ান ক্রাউন জয়ী এই ক্লাইম্বার সফল হলে মুকুটে যুক্ত হবে আরেকটি পালক, বাকী থেকে যাবে শুধুই এভারেস্ট। অসুস্থতার কারনে টম সেইডেন ফিরে গেলেও ৭ই জুলাই বাকী ৩ জন সামিট পুশ শুরু করেন। ১১ই জুলাই তাঁরা ক্যাম্প-৪ থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং প্রচন্ড বাতাস এবং গভীর তুষারের সম্মুখীণ হোন। অবশেষে নর্থ সামিটের একটু নিচে ৭৮০০ মিটার উচ্চতা থেকে নেমে আসার কঠিন সিদ্বান্ত নেন। বেসক্যাম্পে তাঁরা সিদ্বান্ত নেন যে এই মৌসুমে আর এই রুট আরোহণ সম্ভব নয়। তাই তাঁরা ঠিক করেন তাঁরা কিনশোফার রুটেই চেষ্টা চালাবেন। এদিকে বুলগেরিয়ান বোয়ান পেত্রভ, সাভা ইয়াগ্রা এবং ২০১৩ সালে তালেবান হামলায় বেঁচে যাওয়া ইভান টোমভ এসেছিলেন কিনশোফার রুটে ক্লাইম্ব করতে। নরমাল রুটের অবস্থা খারাপ দেখে তাঁরা উত্তর দিকে চেষ্টার সিদ্বান্ত নেন। ১৩ই জুলাই বোয়ান এবং ইভান ক্যাম্প-৪ থেকে যাত্রা শুরু করেন। তাঁরা নর্থ সাইড থেকে কিনশোফার রুটে ট্রেভার্স করেন। কিন্তু প্রচন্ড হোয়াইট আউটের কারনে তাঁরা বাজহিন বেসিন হতে সামিটে যাওয়ার পথটি নির্ণয়ে ব্যর্থ হোন। এদিকে ইভান আক্রান্ত হোন উচ্চতাজনিত অসুস্থতায়। তাই তাঁরা নেমে আসার সিদ্বান্ত নেন। এরপর তাঁরা সিদ্বান্ত নেন কিনশোফার রুটে চেষ্টা করার। কয়েকদিন পর এই দুই টিমের ৭ জনের মধ্যে ৪ জন অসুস্থতার কারনে ফিরে আসার সিদ্বান্ত নিলে বোয়ান পেত্রভ, ফেররান লাটোররে এবং হেলিয়াস মিলারিওক্স একসাথে ঘাঁটছরা বাঁধেন।

২১ই জুলাই শুরু হয় দ্বিতীয় সামিট পুশ। বোয়ান, ফেররান এবং হেলিয়াস ২২ই জুলাই ৬৫০০ মিটারে ক্যাম্প-৩ তে পৌঁছালে শুরু হয় ভয়াবহ ঝড়। দুইদিন ক্যাম্প-৩ তে আটকে থেকে ২৪ই জুলাই আবহাওয়া একটু ভালো পেয়ে তাঁরা ৭২০০ মিটার উচ্চতার ক্যাম্প-৪ এ পৌঁছে যান। ২৫ তারিখ মাঝরাত হতে শুরু হয় ফাইনাল পুশ। এই তিনজন ২৫ই জুলাই স্থানীয় সময় বিকাল ৩.৩০ এ সামিটে পৌঁছেন। এর সাথে সাথে ফেররান এবং বোয়ান ঝুলিতে ভরে নেন নিজেদের যথাক্রমে ১৩ তম এবং ৮ম হিমালয়ান ক্রাউন এবং সবকটিই অতিরিক্ত অক্সিজেন সাহায্য ছাড়া। অন্যান্য সকল টিম অভিযান সমাপ্তি ঘোষনা করায় এই তিনজনের সামিটই হয়ে থাকলো গ্রীষ্মে কিলার মাউন্টেইনে এবারের একমাত্র সফলতা।
গাশারব্রূম-১ (৮০৮০ মিটার)

ছবিঃ গাশারব্রূম-১ এর সাউথ-ওয়েস্ট ফেস
স্পেনিশ টিমের আলবার্তো ইনুরতেগী, হুয়ান ভালেজ্জো, মাইকেল জাবালজা সবার প্রথমে বেসক্যাম্পে পৌঁছেন দুই পর্বত নতুন রুটে ট্রেভার্সের লক্ষ্যে। উল্লেখ্য যে এই ৩ জনের ২ জন ইনুরতেগী এবং ভালেজ্জো যথাক্রমে ১০ম এবং ১৪তম হিমালয়ান ক্রাউন জয়ী ব্যক্তি। পর্বতের এবারের অবস্থা ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক খারাপ। তাই ট্রেভার্সের চিন্তা বাদ দিয়ে তাঁরা পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করেন গাশারব্রূম-২ এর বিখ্যাত সাউথ স্পার। পোলিশ এক ট্রেভার্স টিমও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও হার মানেন। সবাই যখন বাড়ীর পথে তখনই ৪ই আগস্ট ড্রিমার্স ডেস্টিনেশন এক্সপিডিশনের নেতা মিংমা গেলজি শেরপা ঘোষনা করেন যে তিনি সহ দলের ৮ জন সামিটে পৌঁছেছেন। বাকী ৭ জন হলেন দাওয়া গেলজি শেরপা (নেপাল), ডাকিপা শেরপা (নেপাল), আলী রেজা সাদপারা (পাকিস্তান), স্টেফান (জার্মানী), ঝাং লিয়াং (চীন), লিও ইয়ংঝং (চীন) এবং ডং হংজুয়ান (চীন)।
সবার গল্প যখন লেখা শেষ তখন শুরু করলেন গাশারব্রাম-১ সাউথ-ওয়েস্ট ফেস প্রেমিক মারেক হোলসেক। তিনি ইতিপূর্বে ৩ বার এই রুট ক্লাইম্বের চেষ্টা করেছেন। ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে তাঁর সঙ্গী ছিলেন জেনেক হার্বি। ২০১৩ সালের অভিযানে হার্বি মারা গেলে ২০১৫ সালে হোলসেক আবার ফিরে আসেন টমাস পেট্রিককে নিয়ে। ২০১৬ সালেও একই সঙ্গী নিয়ে আসার কথা থাকলেও শেষ মূহুর্তে অসুস্থ হয়ে পরায় তাঁর অভিযান বাতিল করতে হয়। এবারের অভিযানে তাঁর সঙ্গী হোন অন্ড্রা মান্ডুলা। এই দুইজন নরমাল রুটে ৭৫০০ মিটারে অভিযোজিত হয়ে ৯ই আগস্ট হতে সাউথ ওয়েস্ট ফেস ক্লাইম্ব শুরু করলেও পুরোটা সময় জুড়েই ছিল খারাপ আবহাওয়া। ৭৭০০ মিটারে তাঁরা বুঝতে পারেন যে আর এগুনো সম্ভব নয়। বেশ কয়েকদিন মাটি আকড়ে পরে থাকলেও শেষ পর্যন্ত পর্বতের জেদের কাছে হার মানেন হোলসেক এবং ১৩ দিন পর ২২ই আগস্ট বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন এবং অভিযান সমাপ্ত করেন।
ব্রডপিক (৮০৫১ মিটার)
ব্রডপিক অনেকেই ক্লাইম্ব করে থাকেন কে-২ ক্লাইম্বের আগে এক্লামাটাইজেশনের জন্য। তাই ব্রডপিকে পারমিটের সংখ্যা একটু বেশিই হয়। এবার কারাকোরামে প্রথম সাফল্য উপহার দেন স্লোভেনিয়ান আল্পাইনিস্ট জুটি এলেক্স সিজেন এবং লুকা লিন্ডিচ। তাঁরা ১২ই জুলাই শাইনিং ওয়াল ক্লাইম্বের পূর্ব প্রস্তূতি হিসেবে ব্রডপিক সামিট করেন। সামিট আবার যেন-তেন ভাবে করেছেন ভেবে বসবেন না। অন্যরা যখন রোপ ফিক্সিং শেষ হয়নি দেখে নিচে নেমে যাচ্ছিলেন, তখন এই জুটি কোন এক্সট্রা ক্যাম্প, কোন রোপ ফিক্সিং ছাড়াই সামিট করে বসেন।

ছবিঃ সিজেন (বামে ) এবং লিন্ডিচ (ডানে)
স্লোভেনিয়ানরা শাইনিং ওয়ালের উদ্দেশ্যে পর্বত ছেড়ে গেলে এখানে বাকী থেকে যায় আরেকটি আকর্ষণ, স্পেনীশ ক্লাইম্বার অস্কার কেডিয়াক। তিনি ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত অক্সিজেন সাহায্য ছাড়াই ১৩টি হিমালয়ান ক্রাউন জিতেছেন। এবার ব্রডপিক সামিট করতে পারলেই তিনি হয়ে যেতেন সবকটি হিমালয়ান ক্রাউন জয়ী ৩৪তম ব্যক্তি। ১৮ই জুলাই অস্কার সহ অন্যান্যরা উপরের দিকে ক্লাইম্ব শুরু করে ২৩ই জুলাই ক্যাম্প-৩ তে পৌঁছান। আগেরদিনে ঘটে যাওয়া প্রচন্ড তুষারপাতে সৃষ্ট তাজা তুষারের স্তূপ এখানে তাঁদের এগিয়ে চলা অসহনীয় করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই অবস্থায় কেউ কেউ ফিরে যাওয়ার সিদ্বান্ত নিলেও কেউ সিদ্বান্ত নেন এগিয়ে যাওয়ার, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন অস্কার। ৭৮০০ মিটারে খারাপ আবহাওয়া পেয়ে ২৫ই জুলাই তাঁরা ৭৮০০ মিটার থেকে ক্যাম্প-২তে নেমে পরেন। অস্কার সিদ্বান্ত নেন তিনি আবার চেস্টা করবেন এবং সন্দ্ব্যায় তিনি আবার ক্যাম্প-৩ তে উঠে আসেন। ২৬ই জুলাই তিনি ৭৯০০ মিটার হতে আবারো ফিরে আসতে বাধ্য হন। অস্কার এতো সহজে দমার পাত্র ছিলেন না। তিনি ক্লাইম্বিং পারমিট আরো ১০ দিনের জন্য বর্ধিত করার ব্যবস্থা করেন যাতে তিনি আবারো চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কিন্তু এবারো খারাপ আবহাওয়া তাঁদের ৭৩০০ মিটার হতে ফিরিয়ে দেয়।
গাশারব্রূম-২ (৮০৩৫ মিটার)

ছবিঃ গাশারব্রাম-২ সাউথ স্পার
আগেই জেনেছেন যে স্পেনীশ আল্পাইনিষ্ট টিম বেছে নেন গাশারব্রাম-২ এর বিখ্যাত সাউথ স্পার। ১৯৭৫ সালে এই রুট প্রথমবার এবং ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয়বার ক্লাইম্ব হলেও আর সফলতা আসেনি। এই টিমের যোগ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন না থাকলেও এই রুট এবারো পুনরাবৃত্তি হলোনা, কারন খারাপ আবহাওয়া তাঁদের বেশি কিছু করার সুযোগ দেয়নি। ২৬ই জুলাই তাঁরা অভিযানের সমাপ্তি টানেন। এদিকে কমার্শিয়াল এক্সপিডিশনগুলো নরমাল রুটে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। অবশেষে ২৬ই জুলাই স্থানীয় সময় দুপুর ২টার দিকে এক কমার্শিয়াল এক্সপিডিশনের ৮ জন ক্লাইম্বার গাশারব্রাম-২ সামিট করেন। এরা হলেন দাওয়া গেলজি শেরপা (নেপাল), আলী রেজা সাদপারা (পাকিস্তান), লিউ ইয়ংজং (চীন), আরমান হাদ্দাদ (ইরান), রায়ান কুশনার (আমেরিকা), কেলি সোহো (আমেরিকা), লি জেনিংস (আমেরিকা) এবং এন্ডং চুই (কানাডা)।
গাশারব্রূম-৪ (৭৯২৫ মিটার)
৮০০০ মিটারের স্ট্যাটাস অর্জন করতে না পারলেও নিঃসন্দেহে এই মৌসুমের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল গাশারব্রূম-৪ ওয়েস্ট ফেসের বিখ্যাত “শাইনিং ওয়াল”। পোলিশ গ্রেট কুর্টাইকা ও তাঁর সঙ্গী অস্ট্রিয়ান রবার্ট শাওয়ার ১৯৮৫ সালে প্রথমবার শাইনিং ওয়ালের কঠিনতম ওয়েস্ট ফেসে ক্লাইম্ব করে নর্থ সামিটে পৌঁছান।

ছবিঃ গাশারব্রূম-৪ এর শাইনিং ওয়াল বিভিন্ন রুট সহ
২০১৫ সালে পাইওলেট ডি’অর জয়ী স্লোভেনিয়ান জুটি এলেক্স সিজেন এবং লুকা লিন্ডিচ এবার কারাকোরাম এসেছিলেন গাশারব্রূম-৪ এর পরম আরাধ্য শাইনিং ওয়ালের ওয়েস্ট ফেস ক্লাইম্ব করতে। এক্লামাটাইজেশন ট্রিপ হিসেবে ব্রডপিক সামিটের পর তাঁরা নজর দেন মূল টার্গেট শাইনিং ওয়ালে। তবে ওয়েস্ট ফেস ক্লাইম্ব করার আগ্রহ থাকলেও আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে তাঁরা প্ল্যান পরিবর্তন করেন এবং নর্থ-ওয়েস্ট রিজ ক্লাইম্ব করার সিদ্বান্ত নেন। ২৩ই জুলাই বেসক্যাম্প হতে তাঁরা শুরু করেন তাঁদের সামিট পুশ। ২৬ই জুলাই তাঁরা নর্থ সামিটে পৌঁছে যান এবং এরপর ২৮ই জুলাই তাঁরা বেসক্যাম্পে নেমে এসে বাড়ীর পথ ধরার আগে উপহার দিয়ে যান এই সিজনের সবচেয়ে সফল ক্লাইম্ব। এতো বছরের পর্বতারোহনের ইতিহাসে এটা মাত্র ৪র্থ বারের মতো নর্থ-ওয়েস্ট রিজ আরোহন।
অন্যান্য আকর্ষণ
গাশারব্রূম-৬, প্রাকপা রি, লাটক-১, মুজতাগ টাওয়ার – নামক দুষ্ট কারাকোরামের পর্বতগুলো ক্লাইম্বারদের ফিরিয়ে দিয়েছে নির্দয়ভাবে।
পর্বতারোহন বাদে অন্যান্য স্পোর্টসেও চমক কম ছিলনা। তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিল প্যারাগ্লাইডিং করে ৮০০০ মিটার উচ্চতায় প্রথমবারের মতো ঊড়ে যাওয়া। এই অবিশ্বাস্য কীর্তিটি ইতিহাসের প্রথমবারের মতো ঘটিয়েছেন ফ্রান্স এর এন্টনী গিরার্ড। ২৩ই জুলাই ৭ ঘন্টার এক দুঃসাহসী ফ্লাইটে এন্টনী পৌঁছে যান পৃথিবীর দ্বাদশ শীর্ষ পর্বত ব্রডপিকের চূড়ায়। এটিই প্রথমবার প্যারাগ্লাইডিং করে কোন ৮০০০ মিটার শৃঙ্গ সামিট।
অতঃপর মৃত্যু...
এই সিজনে কারাকোরামের সবচেয়ে ভালো দিক ছিল প্রাণ নেয়ার জন্য বিখ্যাত কারাকোরাম পর্বতমালার মনটা এবার নরম ছিলো। ৮০০০ মিটার পর্বতমালায় এবার সবাই নিরাপদে প্রিয়জনের কাছে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু কে জানতো যে মাত্র ৫০০০মিটারের এক পর্বত ‘লায়লা পিক’ এ ঘটে যাবে দূর্ঘটনা! প্রথম স্কি-ডিসেন্টের টার্গেট নিয়ে নেমে আসতে গিয়ে সিজনের শুরুতেই ৯ই জুন প্রাণ হারান ইতালিয়ান স্কি-মাউন্টেনিয়ার ২৭ বছর বয়সী লিওনার্দো কন্নেলী। আবার সিজনের শেষ প্রান্তে এসে ৬৯৮০ মিটার উচ্চতার বাইন্থা ব্রাক-২ (অগ্রি-২) নর্থ ফেস প্রথমবারের মতো ক্লাইম্ব করতে গিয়ে ২২ই আগস্ট চিরতরে হারিয়ে যান আমেরিকান ক্লাইম্বার কাইল ডেম্পস্টার এবং স্কট এডামসন।

ছবিঃ গ্রীষ্ম মৌসুমে পর্বত অনূসারে পরিসংখ্যান
কিছু সফলতা, তিনটি মৃত্যু, কিছু ব্যর্থতা, কিছু অসাধারণ ক্লাইম্ব – সব মিলিয়ে কারাকোরাম পর্বতপাগলদের উত্তেজনার পারদ পুরো গ্রীষ্ম জুড়েই একটুও নামতে দেয়নি।
তথ্য সূত্রঃ পুরো মৌসুমেই বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ, অভিযাত্রীদের ফেসবুক ও টুইটার প্রোফাইল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তাই নির্দিষ্ট কারো নাম নেয়া সম্ভব হলোনা।

Recent Comments