এভারেস্ট’৬২ ও ক্ষ্যাপাটের স্বপ্ন (পর্ব-২)

Share

পড়ুন পর্ব-১

আবহাওয়া ছিল স্থির এবং উষ্ণ। এভারেস্টের পুরো দেয়ালই আজ কালো এবং শুকনো। অভিযোজন নিয়েও কোন সমস্যা নেই। সবকিছুই যখন সামিটের সম্ভাবনা জাগানিয়া, তখনই  নর্থ কোলের নিচে ঘটে গেলো এক দুর্ঘটনা। সামিটে যাওয়ার আগে তাঁদের অর্ধেক পথ আবার নেমে যাওয়া লাগলো পরবর্তী দিনগুলোর রসদ আনতে। উত্তেজিত, উল্লসিত সেয়ার হার্টকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার পর নামতে শুরু করলেন। ওই শীর্ষস্থান থেকে মাত্র ৬০ ফুট নিচে হার্টের পা পিছলে গেলো। অসহায়ভাবে ঢাল দিয়ে পরে যাওয়ার সময় দড়ি সেয়ারকেও টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু’জনই শুন্যে ভাসছিলেন। সেয়ারের মনে হচ্ছিল এই হলো তাঁদের শেষ। এরপর সেয়ার আছড়ে পড়লেন এক তুষার স্তুপে, হার্ট থেকে মাত্র দুই ফুট দূরে। এযাত্রায় বেঁচে গেলেও সেয়ারের একটা পাঁজর ভেঙে গেলো, এবং বাহু ভালোরকমের থেঁতলে গেলো। হার্ট তখন উত্তেজিত এবং দিকভ্রান্ত। এই অবস্থায় তাঁদের তখনকার সমস্যা ছিল ২২০০০ ফুট উঁচুতে খোলা আকাশের নিচে ওই রাত বেঁচে থাকা। তাঁরা হামাগুড়ি দিয়ে এক ফাটলে ঢুকে পড়লেন, নিজেদের ক্ষতবিক্ষত শরীরকে সাথে থাকা সবকিছু দিয়ে মুড়িয়ে নিলেন। এক দীর্ঘ, কষ্টকর রাত্রি শেষে তাঁরা আবার নিজেদের স্যাডেলের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। তখনো তাঁদের মাঝে শীর্ষ আরোহনের দৃঢ় প্রত্যয়। সেয়ার আর তাঁর সঙ্গীদের যাই অভাব থাকুক না কেন, মানসিক দৃঢ়তার কোনোই অভাব ছিলোনা।

নুপা-লাতে সায়ার. ছবি হান্স-পিটার ডুটলের সংগ্রহ

নুপা-লাতে সেয়ার। ছবিঃ হান্স-পিটার ডুটলের সংগ্রহশালা

২রা জুন সেয়ার এবং হ্যানসেন মেলোরীর পদচিহ্ন অনুসরণ করে কোনাকুনি নর্থ-ইস্ট রিজের দিকে আরোহন করে নর্থ কোলের উপরে পৌঁছান। হার্ট ২-১ দিনের মাঝেই তাঁদের সাথে যোগ দেয়ার কথা আর ডুটল পরের ক্যাম্পে আরেকদফা রসদ নিয়ে যাওয়ার কথা। পরের দুইদিন সেয়ার এবং হ্যানসেন প্রচণ্ড তুষার এবং বাতাসের সাথে লড়াই করে রিজলাইন ধরে এগুতে থাকলেন। সেয়ার যেখানে আশা করেছিলেন দিনে ২০০০ ফুট এগুতে পারবেন, সেখানে তাঁদের ৬০০ ফুট এগুনোই কষ্টসাধ্য ব্যাপারে পরিণত হলো।

সেয়ার বুঝতে পারছিলেন এই গতিতে চললে তাঁদের শীর্ষে পৌঁছাতে আরও এক সপ্তাহ লেগে যাবে। অতদিন টিকে থাকার মতো তাঁদের কাছে রসদ বা শক্তি কোনোটিই ছিলোনা। ৫ই জুন সেয়ার ঠিক করলেন আরেকবার চেষ্টা করে দেখলেন কতদূর এগুতে পারেন। মুভি ক্যামেরা এবং অল্প খাবার নিয়ে এগিয়ে তাঁরা ১৯২৪ এর ব্রিটিশ তাঁবুর কাছাকাছি আনুমানিক ২৫৪০০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছালেন। মৌসুমী ঝড় তখনো পেয়ে বসেনি। এই অবস্থায় তাঁরা যদি মেলোরীর ২৬৮০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৬ থেকে যাত্রা শুরু করতেন এই দিনটি হতে পারতো সামিটের উপযোগী এক আদর্শ দিন। কিন্তু শক্তি প্রায় নি:শেষ। ক্ষুধা, তৃষ্নায় কাতর সেয়ার সামিট থেকে মাত্র ২৫০০ ফুট নিচ্ থেকে ফিরে আসার কঠিনতম সিদ্বান্ত নিলেন। সম্ভবত শরীরের টিস্যুগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ায় অর্থাৎ হাইপোক্সিয়ার কারণেই হয়ত: তিনি আরেকটি ভুল সিদ্বান্ত নিলেন। হেঁটে নেমে আসার পরিবর্তে তিনি গড়িয়ে নামতে শুরু করলেন। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলেন। এক পাথরে বাড়ি খেয়ে গড়াতে গড়াতে হাই ক্যাম্পের একটু নিচে প্রায় ৬০০ ফুট নিচে গিয়ে তাঁর পতন থামলো। মাথা এবং বাহু রক্তাত্ম অবস্থায় হ্যানসেনের সাহায্য নিয়ে তিনি কোনোমতে তাঁবুতে আশ্রয় নিলেন।

আইসফলে সায়ারের দল. ছবি হান্স-পিটার ডুটলের সংগ্রহ

আইসফলে সায়ারের দল। ছবি হান্স-পিটার ডুটলের সংগ্রহশালা

এক সপ্তাহের কম সময়ে দুইটি প্রাণঘাতী পতনের অভিজ্ঞতা সেয়ারকে জানিয়ে দিলো তিনি ভাগ্যের বিরুদ্বে খেলছেন। তিনি ভাগ্যবান ছিলেন যে তাঁর আঘাত মূলত মাংস পেশীর উপর দিয়ে গেছে, হাড়ে লাগেনি। দলে কোন ডাক্তার ছিলোনা এবং সহযাত্রীরাও কেউই এতটা অভিজ্ঞ ছিলেন না যে নর্থ কোলের ওই খাড়া, উন্মুক্ত তুষারপ্রান্তর এবং বিশাল খাদে ভর্তি পথ দিয়ে কোন মারাত্মকভাবে আহত ব্যক্তিকে উদ্বার করতে পারবেন। এমনকি যদি পূর্ব রংবুক হিমবাহে নামানো সম্ভবও হয় কোনোভাবে তাঁদের সামনে বাকি থেকে যাবে ২৫ মাইল দূরে নেপালে তাঁদের বেসক্যাম্প।

দলের চারজন সদস্যই ইতিমধ্যে কমপক্ষে একবার করে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন। ১৯২২ সালে নর্থ কোলে তুষারধ্বসে মারা যাওয়া ৭ শেরপা এবং দুইবছর পর হারিয়ে যাওয়া মেলোরি এবং আরভিন সহ ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এভারেস্ট অভিযানে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭ জন। নিজের সর্বোচ্চ উচ্চতায় সেয়ার ১৯৯৯ সালে কোনরাড এঙ্কার যেই স্থান থেকে মেলোরীর মৃতদেহ উদ্বার করেছিলেন তাঁর থেকে মাত্র ১৩০০ ফুট নিচে ছিলেন। ১৯৬২ সালে এভারেস্ট নিয়ে নিতো পারতো আরো চারটি প্রাণ, অজানাই থেকে যেতো গেয়াশুং কাং অভিযানের পরিণতি। হার্ট লিখেছিলেন “ডজনখানেক পরিস্থিতি ছিল যেখানে আমরা মারা যেতে পারতাম। আমরা ছিলাম অনভিজ্ঞ। আমরা কিছু সাংঘাতিক ভুল এবং হিসেবের গরমিল করেছিলাম। আমাদের প্রস্তুতি শীল অপর্যাপ্ত এবং ছিলাম কোন সাহায্য বা উদ্বারকারী দল থেকে অনেক দূরে। আমরা শত শত মিটার গড়িয়ে পরেছি, দুর্ঘটনার রেকর্ড গড়েছি, এবং এখনো বেঁচে আছি।“

নেমে আসাটা ছিল আরেক মহাকাব্য। তাঁরা ছিলেন ক্লান্ত, ক্ষত-বিক্ষত এবং ক্ষুধার্ত। পাখিরা একাধিকবার তাঁদের খাদ্যের সরবরাহ লুন্ঠন করে গেছে। মালবাহক এবং সংযোগ কর্মকর্তা গেয়াশুং কাং এ তাঁদের মৃত ধরে নিয়ে সব রসদ নিয়ে বেসক্যাম্প থেকে ফিরে গেছে। ২১শে জুন “দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস” সেয়ার এবং তাঁর সঙ্গীদের নিখোঁজ হবার খবর ছাপায় এবং ধরে নেয় যে গেয়াশুং কাং এ তাঁরা হারিয়ে গেছেন।

খবর প্রকাশের দুই দিন আগে ক্ষুধার্ত অভিযাত্রীরা বেসক্যাম্পের নিচে এক চাষির ঘরে আশ্রয় নেন যেখানে তাঁরা একটা ভেড়া জবাই করে নিজেদের ক্ষুধা মেঠান। ২৩শে জুন তাঁদের বেঁচে থাকার খবর পেয়ে আমেরিকান দূতাবাস নামছে বাজার থেকে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হেলিকপ্টার পাঠায়। হেলিকপ্টারে ছিলেন নরম্যান ডাইরেনফোর্ট। তিনি ১৯৬৩ এর এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি নিতে নেপালেই ছিলেন। নিজের দেশের অভিযাত্রীদের দুর্দশার খবর পেয়ে নরম্যান সহজাত ভাবেই সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত নরম্যান অন্য সবার মতোই জানতেন যে সেয়ারের দল গেয়াশুং কাং আরোহন করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন।

“কালো প্রস্তরখন্ড, উজ্জ্বল বিশুদ্ধ নীলবর্ণ ছায়ারাশি, ফিনফিনে সাদা স্ফীত তুষার, নীলকান্তমণি নীল খাদ এবং বরফে সূর্য কিরণে হীরের ঝলক…একজন ব্যক্তি সুন্দর একটি গীর্জা দর্শনে সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে, কেনো একজন এমন দৃশ্য দর্শনে ততটুকু বা বেশি করতে পারবেনা?” – উড্রো উইলসন সেয়ার

সেয়ারের মতো নরম্যানও কল্পনাপ্রবণ হলেও তিনি কল্পনাবিলাসী ছিলেন না। তিনি আমেরিকানদের এভারেস্টের চুড়ায় দেখতে চেয়েছিলেন সাবধানতা অবলম্বন করে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে এবং অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে। গত কয়েকবছরে তিনি খুঁজে বের করেছেন ২০ জন সেরা পর্বতারোহীকে। তাঁর ইচ্ছা ছিল নেপালের দিক থেকে বর্তমানে প্রচলিত সাউথ-ইস্ট রিজ ধরে আরোহনের, আর সম্ভব হলে নতুন রুটে আরোহনের। তিনি লক্ষ ডলারের যোগান করেছিলেন এবং নিশ্চিত করেছিলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির আনুষ্ঠানিক সমর্থন এবং কেনেডি এডমিনিস্ট্রেশনের অনানুষ্ঠানিক সমর্থন।

সায়ারের ছোট দল গত ছয় সপ্তাহ আসলেই কোথায় ছিলেন তা শুনে স্বাভাবিকভাবেই হতবুদ্ধি হয়ে যান নরম্যান। চীনা কর্তৃপক্ষ সায়ারের তিব্বতে অনুপ্রবেশের কথা জানলে নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উত্তরের শক্তিশালী এবং যুদ্ধভাবাপন্ন প্রতিবেশীদের শান্ত রাখতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকার এভারেস্ট অভিযানই বাতিল করে দিতে পারেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ঝামেলা এড়াতে সেয়ার নেপালে পুরোটা সময় জুড়েই গেয়াশুং কাং এর গল্প চালিয়ে যান। আমেরিকাতে ফিরে লাইফ ম্যাগাজিনে অভিযানের সত্য ঘটনা বিস্তারিত জানাতে উদ্যোগ নেন সেয়ার। নরম্যান গোপনে অভিযাত্রীদের কাছে বার্তা পাঠান “এই অভিযানের ব্যাপারে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। আমরা আশাবাদী যে এই গল্প কখনো কোথাও ছাপা হবেনা।” তিনি ক্লাইম্বিং কমিউনিটি সেয়ারকে মুখ বন্ধ রাখতে রাজি করাবে এই আশায় আমেরিকান আল্পাইন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট চার্লটন ফুলারকেও চিঠি লিখেন। ফুলার প্রতিউত্তরে জানান যে যেহেতু সেয়ার কোন পর্বতারোহন ক্লাবের সদস্য নন এবং তাঁর তেমন কোন পর্বতারোহী বন্ধুও নেই তাই এই ব্যাপারে তেমন কিছু করণীয় নেই।

এরপর নরম্যান আমেরিকান স্টেট্ ডিপার্টমেন্ট, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, এমনকি প্রেসিডেন্ট কেনেডী’র সাথে পর্যন্ত সেয়ারের কীর্তি’র প্রকাশনা বন্দ্বে যোগাযোগ করলেন। তাঁর অজুহাত ছিল যে এতে হয়ত:  বন্দ্ব না হলেও ভবিষ্যতে হিমালয়ে অভিযান আমেরিকার জন্য সীমিত করা হতে পারে। এমনকি বেশ কিছুদিন ধরে ছুতো খোঁজা চীনের কমিউনিস্টরা নেপাল দখলও করে নিতে পারে। অতীতের দিকে তাকালে নরম্যানের এই উদ্যোগ ফোলানো-ফাঁপানো মনে হলেও শিথিল যুদ্বের সময়কালীন সময়ে তাঁর আসলেই ভিত্তি ছিল। যেমন ১৯৬৫ সালে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে চীনকে শান্ত রাখতে ৩ বছরের জন্য নেপাল বিদেশীদের হিমালয় অভিযানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

১৯৬৩ সালের মার্চে নরম্যানের দল যখন কাঠমান্ডু পৌঁছান তখন লাইফ ম্যাগাজিনে “কমান্ডো রেইড অন এভারেস্ট” নামক উত্তেজক শিরোনামে সেয়ারের দলের গল্প ছাপা হয়। চীনারা আনুষ্ঠানিকভাবে এর দিকে নজর দেয়নি এবং নরম্যানের দলের এভারেস্ট অভিযানও পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। জিম হুইটেকার এবং শেরপা নাওয়াং গোম্বু ১লা মে সাউথ-ইস্ট রিজ দিয়ে সামিটে পৌঁছান। ২১ দিন পর তাঁদের দলের টম হর্নবেইন এবং উইলি আনসোয়েল্ড ওয়েস্ট রিজ দিয়ে প্রথমবারের মতো সামিট করেন।

সেয়ার ১৯৬৪ সালে নিজের গল্পকে বই-এ রূপ দেন “ফোর এগেইনস্ট এভারেস্ট” শিরোনামে, যা প্রায় ২০০০০ কপি বিক্রয় হয়। ১৯৬৩ সালের অভিযান নিয়ে লেখা জেমস রামসি উলম্যান এর “আমেরিকানস অন এভারেস্ট” এবং হর্নবেইন এর “এভারেস্ট: দ্যা ওয়েস্ট রিজ” এর সাথে সেয়ারের বই আমেরিকার তরুণদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করে। সামিটের কোন গর্বিত ছবি না থাকলেও এক দুর্ধর্ষ অভিযানের গল্প, প্রথা বিরোধী ইশতেহার এই বইয়ের প্রতি পাঠকদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। ওই দশকে যেসব আমেরিকান তরুণ পর্বতারোহী প্রচলিত মূল্যবোধ এবং নিয়মের বেড়াজাল ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল এই বই তাঁদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৪ সালে বইয়ের রিভিউ করতে গিয়ে “দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস” শিরোনামে লিখে “মাউন্ট এভারেস্টে সেয়ারের অভিযান ছিল খেপাটে, অপ্রস্তুত ও প্রশংসনীয়”।

নর্থ কোলে সায়ার ছবি হান্স-পিটার ডুটলের সংগ্রহ

নর্থ কোলে সেয়ার। ছবিঃ হান্স-পিটার ডুটলের সংগ্রহশালা

ওই যুগের বেশীরভাগ পর্বতারোহীর কাছেই সায়ারকে মেনে নেয়া ছিল কষ্টকর। ১৯৬২ এ এভারেস্টের ৪ অভিযাত্রী শুধু যে বিদ্রুপের পাত্র ছিলেন তা কিন্তু নয়। তাঁরা আমেরিকান আল্পাইনিজমের ইতিহাসে ভবঘুরে ব্যক্তিত্বের খেয়ালী মনের এক পাতলা প্রলেপ রেখে যান। সেয়ারও ছিলেন উস্কানিদাতাদের দলে। তিনি ১৯৬৩ সালের আমেরিকার এভারেস্ট অভিযানকে প্রায়শই “দ্বিতীয় আমেরিকান এভারেস্ট অভিযান” নামে আখ্যায়িত করতে ভালোবাসতেন।

ব্রিটিশ কিংবদন্তী ডৌগ স্কট ১৯৯৯ সালে সেয়ারের অভিযানের চার্ সদস্য সম্পর্কে বলেন “অপরিপক্ক হলেও এই অভিযান পর্বতারোহণের ধরণ পাল্টাতে বিশেষ অবদান রেখেছিল”। বন্ধুদের একটা দল কৃত্রিম অক্সিজেন, ফিক্সড রোপ, শেরপা সাহায্য এবং তৈরী ক্যাম্প ছাড়াই এগিয়ে গিয়েছিল নিজেদের কল্পনাকে ছুঁতে। নরম্যানের সেনাবাহিনীর চেয়ে সেয়ারের ছোট্ট গেরিলা দল পরবর্তী দশকগুলোতে হিমালয়ে অভিযানের ধরণের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আরেক ব্রিটিশ লিজেন্ড এরিক শিপটন সেয়ারকে লেখা এক চিঠিতে বলেন “এত সামান্য রসদ নিয়ে ওই দীর্ঘ এবং দুরূহ রুটে  তোমরা যতদূর পৌঁছেছে তা এক চমৎকার অর্জন”।

এখন পর্বতারোহন সার্বজনীনতা লাভ করেছে। পুরোনো ক্লাব গুলো হারিয়েছে তাঁদের দ্বাররক্ষক হবার স্বীকৃতি। হিমালয়ে অভিনব পর্বতাভিযানগুলোতে ছোট দলই হয়ে দাঁড়িয়েছে আদর্শ। আধুনিক আল্পাইনিস্টরা এখনো নিজেদেরকে রীতিবিরোধী ভাবতেই ভালোবাসেন। কিন্তু ইদানিং কালের অভিযাত্রীদের বাণিজ্যিক অনুদানের, উন্নত গিয়ার্সের, যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীলতার সাথে – সেয়ারের দলছুটদের মতো সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল উৎসাহের খুব কমই সাদৃশ্য আছে। সেই অভিযানে চার বলিষ্ঠ প্রাণ, কি করছে ঠিকমতো না জেনেই, নিজেদের স্বপ্নকে সত্য করতে এবং শ্রেষ্টত্ব যাচাই করতে সুন্দর এবং ভয়ংকর সুবিশাল বিচ্ছিন্ন পর্বতাঞ্চলে নিজেদের সপে দিয়েছিল। যেমনটি ডুটল বলেছিলেন “১৯৬২ সালে আমরা শুধুমাত্র নিজেদের পথেই হাঁটতে চেয়েছিলাম, কাউকে কিছু না বলে, কারো কোন ক্ষতি না করেই”

…………………………………..সমাপ্ত……………………………………

সূত্রঃ: মরিস ইসারম্যানের “ম্যাড, ইল-ইকুইপড এন্ড এডমায়ারেবল” প্রবন্ধ অবলম্বনে রচিত।  

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *